ওয়েটিং ফর গডো নাটকটি রচনা করেন ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট – Samuel Beckett, যা লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়া যখন চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সামনে, চারদিকে চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ; মানবতা পদদলিত; বেঁচে থাকাই যখন এক বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্ব যখন হয়ে উঠছে এক ভীষণ অর্থহীন বিষয়; ঠিক সে সময়ে নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট তার নাটক ওয়েটিং ফর গডো নিয়ে হাজির হলেন বিশ্ব দরবারে। সেই থেকে চলছে গডোর জন্য অপেক্ষা। হাজারো নৈরাশ্যের মধ্যে একটা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় মানুষের অন্তহীন পথচলা, বিনিদ্র অপেক্ষা, তারই প্রেক্ষাপটে নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক (Absurd Drama) ওয়েটিং ফর গডো।
জীবন মানে কি? জীবন মানে অপেক্ষা, এক অনন্ত, চলমান, ক্ষয়হীন অপেক্ষা। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকে শুধুই অপেক্ষা। জন্মের পূর্বেই জন্মের জন্য অপেক্ষা, জন্মের পরে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষা, অপেক্ষা থাকে কত স্বপ্ন-ইচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের, অপেক্ষা থাকে কত না পাওয়াকে পাওয়ার, অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার। আর জন্মের মুহূর্ত থেকেই তো এক মহাপ্রতীক্ষা থাকেই প্রতিটি জীবনের মৃত্যুর প্রতীক্ষা, সমাপ্তির প্রতীক্ষা, যেন জীবন কোনো কবির সৃষ্টি করা কাব্য, যার শেষ ছন্দ থাকে মিলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
আবার কারো কারো জন্য মৃত্যুতেও শেষ হয় না অপেক্ষার, পড়ে থাকে আরেক অসীম অনন্তের অপেক্ষা, জীবনের পর এক মহাজীবনের অপেক্ষা, কাব্যের পর এক মহাকাব্যের অপেক্ষা। যেন এক ধার্মিক প্রাণ অনন্ত সময় ধরে মুক্তির সন্ধান চাচ্ছে, যেন কোনো ধর্মভীরু ঈশ্বরের সন্ধান চেয়ে বসে আছে জনম জনমের পথ। জীবন যেন এমনই এক প্রতীক্ষার গল্প। এই প্রতীক্ষার গল্প নিয়েই স্যামুয়েল বেকেটের সাজানো যুগান্তকারী নাটক ওয়েটিং ফর গডো।
কিন্তু অন্যান্য সকল অপেক্ষার সাথে স্যামুয়েল বেকেটের বলা অপেক্ষার একটা বড় পার্থক্য থেকেই যায় অপেক্ষার সার্থকতায়। ওয়েটিং ফর গডো তে বেকেট অপেক্ষার চেয়ে বেশি স্পষ্ট করে বলতে চেয়েছেন, সেই অপেক্ষার সার্থকতার বিষয়ে যাবতীয় আয়োজনের লক্ষ্যের বিষয়ে। বুদ্ধিমান মানুষের চাওয়া আর আকাঙ্ক্ষার বিষয় অনেক ও বিবিধ, তাদের অপেক্ষা সীমাহীন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষার পরে কি তৃপ্তি আসে? সকল ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষা কি তাদের জন্য সুখ ও সফলতা নিয়ে আসে?
বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ জানে না তাদের অপেক্ষার কারণ। বোঝে না অপেক্ষার পরে ঠিক কিসের জন্য আশা করে আছে তারা। সারা জীবন ধরে কিংবা জীবনের শেষ মুহূর্তে তারা যে শান্তির ও তৃপ্তির আশা করে আছে তা বাস্তবিক কেমন বা কোন রূপে তা তাদের কাছে ধরা দিতে পারে। মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের সার্থকতাকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ করে যায় বেকেটের এই যুগান্তকারী সৃষ্টি। নাটকটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে এক অন্তহীন অপেক্ষা, নাটকের শেষেও তা থাকে সফলতাহীন, সমাপ্তিহীন বরং সময়ের সাথে অপেক্ষা আরো বেশি সন্দিহান হয়ে পড়ে।
Waiting for Godot Summary in Bengali
Waiting for Godot Characters in Bengali
Waiting for Godot Critical Summary in Bengali
নাটকের শুরু হয় নির্জন রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নাটকের প্রধান দুই চরিত্র ভ্লাদিমির (Vladimir) ও এস্ট্রাগন (Estragon) এর অনিশ্চিত অপেক্ষা দিয়ে, যেখানে আর কেউ নেই, তাদের আর কিছু করার নেই, কার জন্য তারা অপেক্ষা করছে তা তাদের জানা নেই, এমনকি যার জন্য তাদের অপেক্ষা সে তাদের কথা জানে নাকি বা তাদের অপেক্ষায় সাড়া দিয়ে আসবে নাকি তা পর্যন্ত অজানা তাদের।
এই নাটকের সর্বত্র যে হতাশা, অস্থিরতা বা শূন্যতার কথা বলছে, তা একদিক দিয়ে যেমন মানব জীবনের হতাশার প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের অন্তঃসারশূন্য সমাজের ছবিও আঁকে।আবার গাছের নিচে দুজনের অপেক্ষা করতে করতে এস্ট্রাগনের ভ্লাদিমিরকে তাদের মিলিত আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা যেন মানব অস্তিত্বের ওপরই একরকম প্রশ্ন তোলে।
এস্ট্রাগনের জুতা খোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, ইঙ্গিত দেয় (তার) নিজের অস্তিত্বকে ঝেড়ে ফেলার ইচ্ছার দিকেই।এস্ট্রাগনের ঘুমিয়ে পড়ার ফলে ভ্লাদিমির একা হয়ে পড়ার আতঙ্ক, যুদ্ধপরবর্তী সমাজের বিচ্ছিন্নতাকেই চিত্রায়িত করে। ভ্লাদিমিরের বাইবেলের প্রতি অনুরাগ এবং বাইবেলের গল্পের প্রতি অবিশ্বাস, সেই সমাজে ধর্মের অবস্থাকেই নির্দেশ করে। এভাবেই নাটকের ছোট ছোট অঙ্কায়ন জীবন ও সমাজের স্তরে স্তরে লুকানো হতাশা ও শূন্যতাকেই তুলে আনে।
তবে সবচেয়ে বেশি যে চরিত্রের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির মাধ্যমে নাট্যকারের তুলে ধরা অস্তিত্ব সংকটের রূপায়ন পূর্ণতা পায় তা হলো গডোর চরিত্র, যদিও দর্শকেরা বা নাটকের চরিত্ররা কখনোই জানতে পারে না গডো কে বা কেমন। অনেক সাহিত্যবিশারদের মতে, গডো নামটি এসেছে ইংরেজি শব্দ গড (God) থেকে।গডো চরিত্রটি অপেক্ষারত ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগনের কাছে ঠিক তেমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এই পৃথিবীর বিশ্বাসী মানুষেরা ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবছে।
সাধারণ বিশ্বাসী মানুষ জানে না ঈশ্বর কেমন বা কে। তারা জানে না ঈশ্বরকে তারা কোথায় পাবেন।তারা জানে না ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করবেন নাকি অভিশাপ দেবেন, তবুও তারা সেই সত্ত্বার অপেক্ষায় থাকেন, তার করুণার মুখাপেক্ষী হয়। নাটকটিতে ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগনের জীবনও এই একই ভেলায় ভাসমান বলে দেখানো হয়েছে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের কখনো না দেখা, কখনো না জানা গডোর জন্য অপেক্ষায় থাকে।
আশায় বুক বাঁধে, গডো তাদের হতাশাগ্রস্থ, পুনরাবৃত্তিময়, দুর্বিষহ জীবনকে অর্থবহ ও সহজ করে তুলবে। নাটকের দুটি অঙ্কে যেন এই কথাই বারবার উঠে আসে দর্শকের সামনে। এ যেন কোনো কথা ও কর্ম ছাড়াই মানুষের পুরোটা জীবন ও ধর্মের সারাংশকে নীরবে মঞ্চায়িত করা। নাটকটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এটাই যে, এটা মানুষের জীবনের হতাশা ও আশা, দুর্ভোগ ও আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা ও বিশ্বাসকে একইসাথে সবচেয়ে কম শব্দে মঞ্চায়িত করে।
ওয়েটিং ফর গডো নাটকের তুলনামূলক ক্ষুদ্র চরিত্র পজো (Pozzo) ও লাকি (Lucky). যদিও সম্পূর্ণ নাটকে তাদের উপস্থিতি খুবই সামান্য, কিন্তু সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে ওঠে সেই সামান্য ভূমিকার মধ্যেই। পোজো ও লাকিকে দুই অঙ্কেই দেখা যায় পালাক্রমে একে অপরের মনিব ও চাকরের ভূমিকায়।
সমাজের মালিক ও শ্রমিক দুই শ্রেণীকেই যেন প্রতিনিধিত্ব করে এই দুই চরিত্র। একদিকে যেমন দেখা যায় লাকিকে নামে ভাগ্যবান মনে হলেও মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হতে, অপরদিকে পোজো মনিব হলেও তাকে সুখী দেখা যায় না।
বরং প্রতিনিয়ত নিজের সম্পদ, সম্মান আর অবস্থান হারানোর ভয়ে পোজোকে (Pozzo) তটস্থ থাকতে দেখা যায়। আর এই কারণেই দেখা যায় নিজের অধীনস্থের ওপর অকারণ নির্যাতন করে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে। সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষদের জীবনের বাস্তবতা যেন এক অনবদ্য চিত্রে ফুটে উঠেছে নাটকের এই অংশে। সেই সাথে তাদের অবস্থান ও ক্ষমতার পরিবর্তনও দেখায় সময়ের আমোঘ নিয়মকে।
সাহিত্যকে বলা হয় জীবনের দর্পণ। জীবনের সত্য ও মরীচিকাকে স্পষ্ট করে এই সাহিত্য। বেকেটের ওয়েটিং ফর গডোকে এজন্যই ধরা হয় সেই সমসাময়িক সময়ের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যগুলোর একটি হিসেবে। জীবনের অর্থ-অনর্থ, আশা-হতাশা, প্রতীক্ষা-প্রাপ্তির এক দুর্লভ নাট্যচিত্র এই নাটকে। বিশেষ কোনো ঘটনা সূচনাতে না থাকলেও এবং সেই সাথে বিশেষ কোনো সমাপ্তি না থাকলেও দর্শককে রেখে যায় গভীর চিন্তার জগতে, হয়ে ওঠে দর্শকের ভাবনার জগতের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের অনন্য এক খোরাক।
Waiting for Godot Summary in Bengali – Critical Summary – Bangla Summary |
A lot of thanks, dear Sir.
For giving me chance to read valuable information.
Thank you so much Sir
Thanks a lot
জাযাকাল্লাহ